স্বদেশ ডেস্ক:
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে জনপ্রশাসনে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব করা হয়েছে।
অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম-সচিব পদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা দুই গুণ ছাড়িয়ে গেছে।
এতে অতিরিক্ত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাড়া বাবদ একদিকে প্রশাসনিক ব্যয় যেমন হু হু করে বেড়েছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়ায় বাকি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা সামনে আসতে শুরু করেছেন।
পদোন্নতি-পদায়নের দাবিতে অনেকে বিক্ষোভ করছেন, এমনকি বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতিও হতে দেখা গেছে।
একই সাথে, শেখ হাসিনার সরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তাদের সরিয়ে সেখানে নতুন মুখ আনতেও দেখা যাচ্ছে।
ফলে মাথাভারী প্রশাসনের মাথা আগামীতে আরো ভারী হতে যাচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠছে।
এর মধ্যেই আবার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধা পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ কেউ নতুন সরকারকে সহযোগিতা করছেন না।
সব মিলিয়ে ক্ষমতা বদলের দেড় মাস পরেও প্রশাসনে এক ধরনের অস্থিরতা ও সরকারি কাজে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে, যা নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।
কর্মকর্তাদের ভারে ভারসাম্যহীন প্রশাসন
কাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশের জনপ্রশাসন অনেকটা ‘পিরামিডে’র মতো হওয়ার কথা বলে জানাচ্ছেন সাবেক আমলারা।
সাবেক সচিব আবু আলম মো: শহীদ খান বলেন, ‘প্রশাসনের মাথার দিকে জনবল কম থাকবে এবং নিচের দিকে বেশি থাকবে, যা দেখতে অনেকটা মিসরের পিরামিডের মতো।’
অথচ এখন সেটির উল্টা চিত্র দেখা যাচ্ছে।
সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির (জিইএমএস) তথ্যানুসারে, জনপ্রশাসনে নিয়মিত সচিবের পদ সংখ্যা ৬০টি। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সেটি বাড়তে বাড়তে ৮২টিতে উন্নিত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসার পর আগের অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করার পাশাপাশি বেশ কয়েকজন সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি-ও করা হয়েছে কিছু কর্মকর্তাকে। এতে সচিবের সংখ্যা কিছুটা কমে এখন ৭৪টিতে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে, জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২১২টি রাখা হলেও এখন কাজ করছেন দ্বিগুণেরও বেশি কর্মকর্তা।
সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির (জিইএমএস) হিসেবে, বর্তমানে কর্মরত অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা প্রায় ৫৪৬ জন।
এছাড়া একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে যুগ্ম-সচিব পদটির ক্ষেত্রেও।
সরকার অনুমোদিত ৫০২টি পদের বিপরীতে প্রশাসনে এখন যুগ্ম-সচিব হিসেবে কাজ করছেন প্রায় এক হাজার ১৪৭ জন।
আবু আলম মো: শহীদ খান বলেন, ‘অতিরিক্ত এসব কর্মকর্তার কারণে প্রশাসনে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ফলে কাজ-কর্ম যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না।’
রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি
গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে জনপ্রশাসনে যত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তাদের বড় একটি অংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় সেটি পেয়েছেন বলে জানাচ্ছেন বর্তমান ও সাবেক আমলারা।
তিনি বলেন, ‘আশির দশক থেকেই বিভিন্ন সরকারের আমলে কমবেশি এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১০ বছরে এটি মাৎস্যন্যায় পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল।’
মূলত ২০১৪ সালের ‘ভোটবিহীন’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এবং টিকে থাকার কৌশল হিসেবেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাতে রাখতে এটি করেছেন বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা চেয়েছে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। আর পদোন্নতি-পদায়নের লোভে যেসব কর্মকর্তারা তাকে সহযোগিতা করেছেন, তারাই পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন।’
এদিকে, রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়ার ঘটনায় প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তাদের অনেকেই ‘বঞ্চিত’ অনুভব করেছেন বলে জানাচ্ছেন বর্তমান কর্মকর্তারা।
প্রশাসনিক ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএস) আহ্বায়ক ও সচিব ড. মো: আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) যাদেরকে নিজেদের লোক বলে মনে করেছে, বেশিভাগ ক্ষেত্রে বেছে বেছে তাদেরকেই পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে মেধা বা যোগ্যতার ভিত্তিতে সেটি হয়নি।’
নিয়ম-নীতি না মেনে পদোন্নতি দেয়ায় কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে বলেও জানিয়েছেন এই আমলা।
ড. মো: আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, ‘দেখা গেছে, মেধা ও যোগ্যতার দিকে থেকে এগিয়ে থাকার পরও অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতি পাননি। বছরের পর বছর একই পদে আটকে থেকেছেন, কেউ কেউ সেভাবেই অবসরে চলে গেছেন। অন্যদিকে, অনিয়ম-দুর্নীতিতে যারা সরকারকে সহযোগিতা করেছে, ঘুষ দিয়েছে, লবিং করেছে, তাদেরকে পদোন্নতি দিয়ে বড় পদে বসানো হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, যা এখন প্রকাশ পাচ্ছে।’
গত দেড় মাসে অসংখ্য সাবেক আমলা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবেদন করে অভিযোগ করেছেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে অবসরে পাঠানো হয়েছে।
তাদের অনেকে এখন চাকরিতে ফিরে আসতে চাচ্ছেন, ক্ষতিপূরণও দাবি করছেন কেউ কেউ।
অবসরে যাওয়া বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে কাজে ফেরানো হয়েছে, যাদের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো: মোখলেস উর রহমানও রয়েছেন।
নজিরবিহীন বিক্ষোভ ও অস্থিরতা
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনপ্রশাসনে যে মাত্রায় বিক্ষোভ ও অস্থিরতা দেখা গেছে, বাংলাদেশে আর কখনোই সেটি দেখা যায়নি বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক সচিব আবু আলম মো: শহীদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনটা নজিরবিহীন। এমনকি ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও প্রশাসনে এমন অস্থিরতা দেখা যায়নি।’
বস্তুতঃ গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই জনপ্রশাসন এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে।
গত দেড় মাসে প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হতে দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকশ কর্মকর্তাকে।
জনপ্রশাসন, নৌপরিবহনসহ বেশকিছু মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবদের করা হয়েছে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওএসডি)।
বাতিল করা হয়েছে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পররাষ্ট্র সচিবসহ আগের বেশিভাগ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। কেউ কেউ স্বেচ্ছায়ও পদত্যাগ করেছেন।
জেলা প্রশাসক নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের একপর্যায়ে গত ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে।
আবু আলম মো: শহীদ খানের কথায়, ‘পদোন্নতির জন্য এমন জোর-জবরদস্তি আগে কখনোই দেখা যায়নি।’
আর এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএস)।
বিএএসের আহ্বায়ক ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, ‘নিয়ম-নীতি না মেনে আগে দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি-পদায়ন করার কারণে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, সেটির ফলশ্রুতিতেই এখন এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে।’
কাজে ধীরগতির যত কারণ
পদোন্নতি ও পদায়নকে ঘিরে প্রশাসনে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রশাসনিক কাজে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার দেড় মাস পরেও প্রশাসনে শৃঙ্খলার অভাব ও কাজে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মো: শহীদ খান বলেন, ‘পদায়ন-পদোন্নতি নিয়ে কর্মকর্তারা এভাবে বিক্ষোভ করতে থাকলে সরকারি কাজে ধীরগতি আসাটা খুবই স্বাভাবিক।’
এদিকে, প্রশাসন ক্যাডারদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতে দেখে এখন অন্য ক্যাডাররাও সেপথে হাঁটতে শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে হট্টগোলের এক সপ্তাহ পার না হতেই যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতির দাবিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যান অন্য ক্যাডারগুলো থেকে উপসচিব হওয়া দেড় শতাধিক কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের একটি অংশ নতুন সরকারকে সহযোগিতা করছে না বলে অভিযোগ তুলেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও অবশ্য বিষয়টি স্বীকার করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘অল্প কিছু কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সবাই সরকারকে সহযোগিতা করছেন।’
কিন্তু ওই কর্মকর্তারা আসলে কারা?
আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, ‘আগের সরকারের সময়ে যারা অনিয়ম ও অনৈতিকভাবে সুবিধা নিয়েছেন, বিভিন্ন পদে বসেছেন, তারাই মূলত এখন সরকারকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন।’
এছাড়া প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে যারা ‘দুর্নীতিবাজ এবং অল্প কয়েক মাসের মধ্যে যারা অবসরে চলে যাবেন’, তাদের অনেকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন না বলেও জানিয়েছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের এই কর্মকর্তা।
সব মিলিয়ে প্রশাসনে এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সেটি সমাধান করে কাজে গতি ফেরাতে না পারলে নতুন সরকার ভাবমূর্তির সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক সচিব আবু আলম মো: শহীদ খান বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্য এ সরকার যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলো দৃশ্যমান করে তোলার জন্যই প্রশাসনে অস্থিরতা থামানো জরুরি। বেশিদিন এই অস্থিরতা চলতে থাকলে সরকার ইমেজ সঙ্কটে পড়তে পারে।’
মেধা ও অর্থের অপচয়
সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিবসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল রাখার ফলে সরকারি অর্থের বাড়তি খরচ হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
মূলত পদোন্নতি পাওয়ার সাথে সাথে সরকারি একজন কর্মকর্তার মূল বেতন যেমন বাড়ে, তেমন বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, ভ্রমণ ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা ইত্যাদি নানান সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রতিটি পদোন্নতির সাথে সাথে সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়।
বিএএসের আহ্বায়ক আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, ‘কাজেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পদোন্নতি দেয়া মানেই জনগণের করের টাকার অপচয়।’
অর্থ বিভাগের হিসেবে, গত এক দশকে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় সরকারের ব্যয় প্রায় আড়াই গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২৮ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। ১০ বছর পর, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সেটি বাড়িয়ে একইখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে এর মধ্যে ভাতা বাদে কেবল কর্মকর্তাদের বেতনের জন্যই খরচ ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, অপ্রয়োজনীয়ভাবে পদোন্নতি দেয়ার কারণে মেধারও অপচয় হচ্ছে। এক্ষেত্রে একই পদে একাধিক লোক থাকায় অনেকে মেধা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না বলে জানা যাচ্ছে।
আনোয়ার উল্ল্যাহ মনে করেন, ‘যেখানে দু’জন লোক দরকার, সেখানে পাঁচজন থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাকিরা পদ অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন।’
আবার বরাদ্দের চেয়ে সংখ্যা বেশি হওয়ায় অফিস কক্ষসহ নানান সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগি করতে হচ্ছে, যার ফলে মাঝে মধ্যে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এর বাইরে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের অনেকে সরকার বদলের পর ওএসডি হচ্ছেন।
আবু আলম মো: শহীদ খান বলেন, ‘আর ওএসডি করার পর সাধারণত তাকে কাজ বা দায়িত্ব দেয়া হয় না, কিন্তু বেতন-ভাতা দেয়া হয়। ফলে এটিও সরকারি অর্থ ও মেধার অপচয়।’
দায় কার?
মাথাভারী প্রশাসনের কারণে রাষ্ট্রের অর্থ ও মেধার অপচয়ের পাশাপাশি প্রশাসনিক কার্যক্রমে যত জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে, সেটার জন্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই প্রধানত দায়ী করছেন বর্তমান ও সাবেক আমলারা।
আবু আলম মো: শহীদ খান মনে করেন, ‘বর্তমানে পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, সেটার জন্য প্রধানত রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। কারণ প্রতিটি সরকারই কম-বেশি রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন।’
তবে এর পেছনে কর্মকর্তাদেরও দায় রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘পদোন্নতি-পদায়নের লোভে কর্মকর্তারাও ক্ষমতাসীনদের সাথে হাত মেলাচ্ছেন। ফলে দু’পক্ষেরই দায় রয়েছে।’
দেশের গত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন বলে মনে করেন অনেকে।
যারা এই কাজে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন, তাদেরকে বড় পদোন্নতি-পদায়ন দিয়ে ‘পুরস্কৃত’ করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
এর বাইরে, প্রশাসনকে নিজেদের পক্ষে রাখতে শেখ হাসিনার সরকার ঘন ঘন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরের শাসনকালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে প্রায় ৪০৬ শতাংশ।
যে সময়ের মধ্যে বেতন-ভাড়া বাড়ানোর এই ঘটনা ঘটেছে, তখন পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দলটির বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।
এমনকি নির্বাচনের আগে নৌকার পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট চাইতেও দেখা গেছে তাদের।
‘অথচ সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণবিধিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে তারা কোনো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে অংশ নিতে পারবেন না,’ বলেন আবু আলম মো: শহীদ খান।
তিনি বলেন, ‘কাজেই যারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন, দায় তাদের নিতেই হবে।’
তবে কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অবশ্য দাবি করছেন, রাজনৈতিক সরকারের চাপের মুখেই তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না।
সরকারের যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকারে অধীনে থেকে তাদের বিরোধিতা করি কী করে? বিপক্ষে গেলেই তো আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে, ওএসডি করে রাখবে। এমন অসংখ্য নজির রয়েছে।’
তাহলে এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
মো: শহীদ খান বলেন, ‘এটা থেকে বের হওয়ার উপায় হচ্ছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনের সুরক্ষা দেয়া।’
সরকারি চাকরিজীবীদের সুরক্ষায় বাংলাদেশে ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ নামে একটি আইনটিও পাশ হয়েছে।
তিনি জানান, ‘এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনে সুরক্ষা দেয়া গেলে প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, তথা নিরপেক্ষ রাখা সম্ভব।’
কী বলছে সরকার?
প্রশাসনে এখন যে অস্থিরতা ও কাজে যে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে, সেটার জন্য দলীয়করণই সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘দলীয়করণের ফলে প্রশাসনে যে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, সে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সেবাখাতগুলোতে দলীয়করণের ফলে বেশি ক্ষতি হয়েছে।’
বর্তমান সরকার সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠে প্রশাসনকে পুনরায় নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন এই উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। তবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরেকটু সময় লাগবে।’
জনপ্রশাসনকে ঠেলে সাজানোর জন্য গত ১১ সেপ্টেম্বর একটি কমিশন গঠন করেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ওই কমিশন আগামী ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবে এবং ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে।
দলীয় প্রভাব ও দুর্নীতিমুক্ত করার পাশাপাশি প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব করে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই নতুন এই কমিশন কাজ করবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, ‘প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য যা যা ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, সেগুলোর সবই সরকার গ্রহণ করছে।’
প্রশাসনে এখন যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, খুব শিগগিরই সেটা কেটে গিয়ে কাজে গতি ফিরবে বলেও আশা করছেন এই উপদেষ্টা।
সূত্র : বিবিসি